বিদায় ২০২০ : তবু অনন্ত জাগে!

এ সময়ে যাদের বাস তারা ২০২০ সালটাকে মনে রাখবে বহু দিন। সময় আসে সময় যায়। কিন্তু থেকে যাওয়া সময়টায় যখন বেদনার কাব্য লেখা থাকে তখন তা মনে দীর্ঘ আঁচড় দিয়ে যায়। ২০২০ তেমনই একটি বছর।

পুরো বিশ্ব নতুনভাবে বাঁচার রাস্তা হাতড়ে বেড়িয়েছে বছরজুড়ে। মানুষজন মাসের পর মাস ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। টানা একটা বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুখর হয়নি শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড়ে। এমন তিক্ততাতেই শেষ হচ্ছে ২০২০।

সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ-বেদনার কাব্য। আজকের সূর্যাস্ত আরেকটি খ্রিস্টীয় বছরের ইতি টানছে। আগামীকালের ভোরের সূর্য পৃথিবীর বুকে নিয়ে আসবে আরেকটি নতুন বছর।

পেছনে ফেলে যাচ্ছি যে বছর সেটি অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখে। নানা ক্ষেত্রে ঘটেছে উত্থান-পতন। করোনা মোকাবিলা করে অবরুদ্ধ মানুষ নিজেকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। সবার আশা, যাবতীয় বাধা পেরিয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার লক্ষ্যে।

কেমন কাটলো ২০২০? রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ থাকা, মানুষের চলাচল ব্যাহত বা কর্মহীন হয়ে পড়া- যাই হোক না কেন, সামনে দেখাটা জরুরি। তারা বলছেন, যে বছরটি আজ শেষ হচ্ছে তাতে আমাদের কাজের পরিধি সংকুচিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেককে বাস্তবতা বুঝতেও শিখিয়েছে। কে কবে ভেবেছিল একটি শিক্ষাবর্ষ জীবন থেকে ঝরে পড়বে? কে ভেবেছিল কেবল আমাদের দেশ নয়, একই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে একসঙ্গে পথ খুঁজবে সারা বিশ্ব? সুতরাং, এর মধ্য থেকেই জীবনকে খুঁজে বের করতে হবে।
কোভিড ১৯-এর আচমকা আক্রমণে একদিকে যেমন জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে এই সময়টা আমরা জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি উল্লেখ করে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেন, ‘ফিরে দেখার সুযোগ হয়েছে- কী আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আর কী নয়। আমার নিজের কথা যদি বলি, দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকাটা খুবই দমবন্ধ অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটানো গেছে। গত ১৫ বছর কখনোই দুপুরের খাবার সবার সঙ্গে খাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই সময়টাতে তা করতে পেরেছি। অনেক অনলাইন কোর্স করেছি। অনেক নতুন জিনিস শিখতে পেরেছি। জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়া যে আসলে তুচ্ছ ও অপ্রয়োজনীয় সেটাও উপলব্ধি করেছি।’
তবে যতই ইতিবাচকভাবে দেখা হোক না কেন, কোভিডের কারণে মানসিক অবসাদও অনেক ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক প্রিয় মানুষকে আবার দেখবো কিনা সেটা ভেবে শিউরে উঠেছি। অনেক সহকর্মী কাজ হারিয়েছেন। পরিচিত অনেক দিনমজুর উপোস করেছেন। আমরা সবাই চেষ্টা করেছি একে অপরকে সহায়তা করতে। কিন্তু সেটা অপ্রতুল ছিল। সব মিলিয়ে বিষণ্ন একটা সময় পার করেছি। আমরা এমন এক প্রজন্ম, যারা বড় কোনও দুর্যোগ ছাড়াই জীবন পার করে দেবো ভেবেছিলাম। আমরা কোনও যুদ্ধ দেখিনি, দেশান্তরী হইনি, বড় রোগবালাই বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়িনি। কোভিড-১৯ ছিল আমাদের জন্য বড় আঘাত। সেই আঘাত ধীরে ধীরে কাটিয়ে সবাই স্বাস্থ্যবিধিকে জীবনাচারের অংশ করে ধীরে-সুস্থে এগুচ্ছে, এটাই নতুন বছরে একটা বড় সান্ত্বনা।’
এই বছরের যে লড়াই তার অনেকটা পরের বছরেও বয়ে বেড়াতে হয় কিনা সেই শঙ্কা প্রকাশ করে নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম রেজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসছে নতুন বছর। কিন্তু বছরটা পার হচ্ছে কিনা নিশ্চিত নই। আগের বছরটা কি লেপ্টে থাকবে নতুন বছরের শরীরজুড়ে! সে বিচারে যেয়ে বেদনা যাপন আপাতত থাক। নিরানন্দ রাজত্ব করছে বলে কি হাল ছেড়ে বসে থাকবো? নিশ্চয় নয়। অসংখ্য স্বজন, বন্ধু, সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। তার শোক হৃদয়ে লুকিয়ে নতুন বছরকে আবাহন করছি। করোনার বছরে কিছুই করতে পারিনি, তা তো নয়। আমি থিয়েটারের মানুষ, নাটকের মানুষ। অতিমারি যখন এ দেশে ছোবল দিলো তখন থেকে বেশ কিছু দিন স্থবির ছিল আমাদের সবকিছু। সে অবস্থা কাটিয়ে আমরা মঞ্চে ফিরেছি, টিভি সিনেমার পর্দায় ফিরেছি। মানুষ ফিরেছে প্রাত্যহিকতায়। একটা বিষয় লক্ষ করেছি যে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিয়ে চলাচল করলে নিরাপদে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভ্যাকসিন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিজেরা সুরক্ষাবিধি মেনে চলি, এটাই আমার নতুন বছরের ইরাদা।’
তবু অনন্ত জাগে
তবু অনন্ত জাগে
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘করোনা মহামারি শুধু মৃত্যুঝুঁকিই সৃষ্টি করেনি, মানুষের অর্থনীতিকেও চরমভাবে বিপর্যস্ত করেছে। এ অবস্থা থেকে কোনও দেশই নিস্তার পায়নি। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত। সমস্যাগুলো সম্মিলিতভাবে সমাধান করতে হবে। প্রত্যেকের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এমন সিদ্ধান্ত দরকার। করোনা কারও প্রতি বৈষম্য করেনি। সবাইকে শিখিয়ে দিলো, যে কেউ যে যেকোনও সময় ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আগামীতে সকলকে নিয়ে ভাবার একটা চর্চা তৈরি হবে, সেই কামনা রইলো।’

করোনাভাইরাসের চেয়েও ‘মৌলবাদ ভাইরাস’ বিপজ্জনক উল্লেখ করে বাংলাদেশের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০২০ করোনা মোকাবিলাতেই কেটেছে। আমি মনে করি এর চেয়েও ভয়াবহ মৌলবাদের ভাইরাস, যা প্রতিনিয়ত আমাদের ছোবল দিতে উদ্যত থাকে। করোনার ভ্যাকসিন আছে এখন। মৌলবাদের ভ্যাকসিন ৭২-এর সংবিধানে আছে। কিন্তু সেটার প্রয়োগ দেখছি না। এ বছরও সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে দেখি না। এটা উদ্বেগের। ২০২১ সালে করোনা মহামারির ছোবল থেকে বাংলাদেশ ও পৃথিবী বিপদমুক্ত হবে এই কামনা যেমন করছি, তেমনই মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের যে ভাইরাস সেটার নির্মূল কিংবা নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে দেখবো, সেই কামনাও রইলো।’